আগুন নেভানোর জন্য নতুন করে আগুন জ্বালানো হিংসা ও প্রতিশোধের নতুন ধাপ! --আফ্রিকার উপকথা ক্রিকেটে পাকিস্তানের সঙ্গে সেই দেশের মাটিতে বাংলাদেশ দশ উইকেটে জয়ের পর একটা কৌতুক ছড়িয়ে পড়েছে। কৌতুকটা এমন- ‘ক্রীড়া উপদেষ্টা—কী উপহার চাই আপনাদের? গাড়ি, ফ্ল্যাট নাকি নগদ অর্থ?’
কেউ কিছু বলছে না দেখে সাকিব আল হাসান বললেন- ‘আমি কিছু চাই না। খুনের মামলার আসামি হিসেবে যখন আমাকে আদালতে নেওয়া হবে, তখন কি আমি ফুলপ্যান্টের নিচে ওই বিশেষ গার্ডটা পরতে পারবো?’
মামলাও কখনও কখনও কৌতুককর হয়। কাউকে ধ্বংস করার জন্য নাকি তিনটি তিতা আর একটা মিষ্টি উপায় আছে। তিনটা তিতা উপায় হচ্ছে নেশাসক্ত করে তোলা, জুয়া খেলায় আসক্ত করা আর মামলায় জড়িয়ে ফেলা। মিষ্টি উপায়টা হচ্ছে বিয়ে দিয়ে দেওয়া। আজকের লেখার বিষয় ধ্বংস করার বা হওয়ার জন্য তিন তিতা উপায়, যার তৃতীয়টা বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে কোনও একদিন! আজ আপনি দম্ভ নিয়ে কাউকে জঙ্গলের মধ্যে কলাপাতায় শুয়ে থাকতে বাধ্য করছেন, কাল আপনার জীবনে সেই দিনটা ফিরেও আসতে পারে! সে কারণে ছবির নাম হয়– আজ আমার কাল তোমার (টুডে ইটস মি টুমরো ইউ!)
মানুষের অনেক নেশা থাকে। সবচেয়ে বড় নেশা নাকি ক্ষমতায় থাকার নেশা। এদের বলা হয় ক্ষমতা মাতাল। কবি শামসুর রাহমান যেমনটি লিখেছিলেন– ক্ষমতা মাতাল জঙ্গি প্রভুরা শোনো…! ক্ষমতায় থাকলে জুয়া বা ব্যাংক খেলাও ভালো জমে। কয়েক দানে মানুষের হাজার কোটি টাকা যেমন মেরে দিতে পারতেন ঋণের নামে, যেমন শেয়ার বাজারে ধস নামাতে পারতেন ব্যবসায়ী ও পতিত শেখ হাসিনা সরকারের শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, যেমন কয়েক দানে সাতটা ব্যাংক খেয়ে ফেলতে পারতেন এস আলম গ্রুপের মালিকরা, ক্ষমতার জুয়া খেলাটা তেমনই। কিন্তু তৃতীয় তিতা বিষয়টা?
তৃতীয় তিতা বিষয় ‘মামলা’ হচ্ছে বিরোধী দল দমনের সবচেয়ে বড় আইনি অস্ত্র। বিভিন্ন আমলে মামলার চরিত্রগুলো কিন্তু ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় পূর্ণ এবং কৌতুককর। যেমন ধরুন, আপনি কোনও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। আপনাকে সাইজ করতে চায় নতুন সরকার। আপনার বিরুদ্ধে থালা-বাটি কেনায় দুর্নীতির মামলা দেওয়া হলো এবং আপনি জেলে গেলেন। সরকার আপনাকে ভিসি পদ থেকে সরাতে পারলো এবং অনুগত নতুন কাউকে বসানো হলো। ধরুন আপনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। আপনি যখন ক্ষমতায় নেই তখন আপনার বিরুদ্ধে বঙ্গভবনের পর্দা কেনাতে নয় ছয় করার মামলা দেওয়া হলো এবং আপনি জেলে গেলেন। মামলার এই ঐতিহ্য আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি এবং ক্ষমতার পালাবদল হলে মামলা কেন যেন পুরনো ঐতিহ্য নিয়েই ফিরে আসে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধেও এমন মামলা দিতো পশ্চিম পাকিস্তানিরা। একই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন দেশে ফেরিতে ভাঙচুর ও বাসন কোসন নষ্টের দায়ে এমপি’র বিরুদ্ধে মামলা হবার রেওয়াজ আছে। সিনেমা হলে বোমা ও অগ্নিসংযোগ ও ষড়যন্ত্রের দায়ে শিক্ষকদের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা আছে। আবার মামলার পরিণতির জন্য জজ মিঞার গল্প ফাঁদারও রেওয়াজ আছে। এই গল্প ছড়ানোর দিন কি আবারও ফিরে এলো?
ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর মামলার এই ঐতিহ্যপ্রিয়তা এবং পুলিশি গল্প বদলে যাবে, এমন আশাই করেছিলাম আমরা। কারণ ১৬ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনে মামলাবাজিতে কিছু নতুন মাত্রা যোগ হয়েছিল। সেটা হচ্ছে মামলার সংখ্যা বাড়ানো ও অজ্ঞাতনামা যোগ। গত ১৬ বছরে বিএনপির যেসব নেতার নামে দুইশ’র বেশি মামলা হয়েছিল, দিনে হয়তো তার বা তাদের কয়েকটা মামলার হাজিরা থাকতো। দিন যেত তখন আদালত প্রাঙ্গণে হাজিরা দিতে- রাজনীতি, ব্যবসা কিংবা চাকরি তার বা তাদের পক্ষে করা অসম্ভব ছিল। যে পত্রিকা স্বাধীনতা দিবসে মাংস খাবার স্বাধীনতা নিয়ে রিপোর্ট করেছিল তাদের বিরুদ্ধে দেশের একাধিক স্থানে মামলা করা হয়েছিল। ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের নামেও দেশের একাধিক স্থান থেকে একাধিক মামলা দেওয়া হয়েছিল।
এই ধারা অব্যাহত ছিল, এখনও আছে। আদালতে নেওয়ার পথে ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের ওপর হামলা হয়েছিল। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মাধ্যমে মানুষকে নিগ্রহ করার এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি কতটা বদলেছে? যে পুলিশ বাহিনীর মাধ্যমে গল্প ফাঁদা, গ্রেফতার ও অজ্ঞাতনামার চল প্রচলন করা হয়েছিল, তাদের সঙ্গে কি আরও কিছু মাত্রা যোগ হয়েছে?
কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক...
পোশাককর্মী রুবেল হত্যা মামলার ২৮ নম্বর আসামি করা হয়েছে ক্রিকেটার কাম সাবেক এমপি সাকিব আল হাসানকে এবং ৫৫ নম্বর আসামি করা হয়েছে চিত্রনায়ক ও সাবেক এমপি ফেরদৌসকে। রুবেল হত্যার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে, সাকিব তখন ছিলেন বিদেশে। ধরে নিচ্ছি ক্রিকেট টিমে থাকাকালীন ২০২৪-এর জানুয়ারি মাসে ভোটারবিহীন ডামি নির্বাচনে আওয়ামী প্রার্থী হওয়ার কারণে সাকিবের ওপর অনেকেই নাখোশ। সাকিব আল হাসান কিছু কাজ করে আগেই বিতর্কিত হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট মামলা দেওয়া যেত। যেমন– ই-অরেঞ্জের প্রতারণা বা শেয়ার কেলেঙ্কারি, আরাভ খানের সঙ্গে সোনার ব্যবসা, ক্রিকেট জুয়ার সাথে জড়ানো, এমনকি কোনও কোনও তরুণীর মন ভাঙার জন্য মামলা দেওয়া যেত। কিন্তু খুনের মামলা কেন? চিত্রনায়ক ফেরদৌস হয়তো আওয়ামী লীগ আমলের সুবিধাভোগী ছিলেন, কিন্তু তিনি কি খুনের সাথে জড়িত?